কুমিল্লার খাদি, ইতিহাস ও সংকট

কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ের রামঘাটলায় গেলেই দুপাশে দেখা মিলবে খাদি বা খদ্দর শিল্পের অনেকগুলো বিক্রয়কেন্দ্র। এছাড়া নগরীর খন্দকার প্লাজার পাশেও বেশ কয়েকটি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। জেলার চান্দিনা উপজেলায় রয়েছে বেশ কিছু খাদি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। কুমিল্লার একটি অন্যতম ঐতিহ্য এই খাদি বা খদ্দর শিল্প।

জেনে নেওয়া যাক খাদি শিল্প সম্পর্কে

প্রাচীনকাল থেকে এই উপমহাদেশে হস্তচালিত তাঁত শিল্প ছিল জগদ্বিখ্যাত। দেশের চাহিদা মিটিয়ে সবসময় এই তাঁতের কাপড় বিদেশেও রপ্তানি হতো। একটি পেশাজীবী সম্প্রদায় তাঁত শিল্পের সাথে তখন জড়িত ছিলেন; তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘যুগী’ বা ‘দেবনাথ’।

কুমিল্লার খাদি যেভাবে পরিচিতি পায়

ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ ভারতে ১৯২১ সালের দিকে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের সময়কালে ঐতিহাসিক কারণে এ অঞ্চলে খাদি শিল্প দ্রুত বিস্তার লাভ ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তখন খাদি কাপড় তৈরি হতো রাঙ্গামাটির তুলা থেকে। জেলার চান্দিনা, দেবিদ্বার, বুড়িচং ও সদর থানায় সে সময় বাস করত প্রচুর যুগী বা দেবনাথ পরিবার। বিদেশি বস্ত্র বর্জনে গান্ধীজীর আহ্বানে সে সময় কুমিল্লায় ব্যাপক সাড়া জাগে এবং খাদি বস্ত্র উৎপাদনও বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে কুমিল্লার খাদি বস্ত্র। এই বস্ত্র জনপ্রিয়তা পায় কুমিল্লার খাদি হিসাবে।

গান্ধীজীর প্রতিষ্ঠিত অভয় আশ্রম খাদি শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রাখে

গান্ধীজীর প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লার অভয় আশ্রম খাদি শিল্প প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনুশীলন চক্রের আশ্রয়স্থল হিসেবে ছদ্মবরণে প্রতিষ্ঠিত সমাজ কল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভয় আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদেশি কাপড় বর্জনের ডাকে যখন ব্যাপক হারে চরকায় সুতা কাটা শুরু হয়। অভয় আশ্রম তখন সুলভে আশ্রমে তৈরি চরকা বাজারে বিক্রির পাশাপাশি নিজেরাও তৈরি করতে থাকে খাদি বস্ত্র। বিভিন্ন গ্রামে তৈরি খাদি বস্ত্রও এ সময় অভয় আশ্রমের মাধ্যমে বাজারজাত করতে শুরু করে।

খাদি কাপড়ের তৎকালীন মূল্য যেমন ছিল

জানা যায়, ১৯২৬-২৭ সালে একটি ৮ হাত লম্বা ধূতি বিক্রি হতো মাত্র পাঁচসিকে দামে। সে সময় কুমিল্লা অভয় আশ্রম প্রায় ৯ লাখ টাকা মূল্যের খাদি কাপড় বিক্রি করেছিল। প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীত বিশারদ, অভয় আশ্রমের একজন কর্মী পরিমল দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, বিপুল চাহিদা থাকলেও অভয় আশ্রম থেকে সে চাহিদা সম্পূর্ণভাবে পূরণ হতো না।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে খাদি শিল্পের অবস্থা

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় খাদি শিল্পের ছিল স্বর্ণযুগ। এর পরপরই আসে সংকটকাল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বস্ত্রকলগুলো তখন বন্ধ। বস্ত্র চাহিদা মেটাতে আমদানি নির্ভর দেশে হস্তচালিত তাঁতের কাপড়ের ওপর প্রচুর চাপ পড়ে। দেশের বা মানুষের চাহিদার তুলনায় খাদির উৎপাদন ব্যাপক না হলেও চান্দিনা বাজারকে কেন্দ্র করে আশপাশের গ্রামগুলোতে তাঁতীরা চাদর, পর্দার কাপড়, পরার কাপড় তৈরি করতে শুরু করে।

খাদির বর্তমান অবস্থা

কুমিল্লা জেলার সাথে খাদিশিল্প আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। একসময় এই খাদির খুব প্রচলন ছিল। কুমিল্লায় আগে গান্ধী অভয়াশ্রমে এ খাদি তৈরি হতো। কুমিল্লা শহরের চান্দিনা উপজেলায় এখনও গান্ধীজীর স্মৃতিবিজড়িত তাঁত রয়েছে। বর্তমানে কুমিল্লার খাদিপণ্যের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ‘খাদি কটেজ’, ‘পূর্বাশা গিফট এন্ড খাদি’, ‘খাদি হাউজ’, ‘খাদি আড়ং’, ‘গ্রামীণ খাদি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

কুমিল্লা জেলার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে খাদি

কুমিল্লা জেলার চান্দিনায় অবস্থিত ‘গ্রামীণ খাদি’র সত্ত্বাধিকারী অরুণ গুহর সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে খাদির কাপড়ের যথেষ্ট চাহিদা না থাকলেও দেশে এবং বিদেশে ছোট-ছোট লটে খাদি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। ফ্রান্স, স্পেন, ডেনমার্ক, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই পণ্য রপ্তানি হয়। বর্তমানে এই শিল্প টিকে থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে এর অস্তিত্ব নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তুলার অপর্যাপ্ততা এবং চাহিদার সীমাবদ্ধতা। বর্তমানে মেশিনের সাথে পাল্লা দিয়ে হস্তচালিত তাঁত দ্বারা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। ভবিষ্যতে এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে বছরে অন্তত একটি করে হলেও খাদি বা খদ্দরের জামা সকলের কেনা প্রয়োজন বলে তিনি জানান।

Related Posts

Clothing
Muslim Corner

খাদির কদর বাড়ছে

চরকায় বোনা খাদি কাপড় আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ। হাজার বৈচিত্র্যের মধ্যেও খাদি পোশাকের গুরুত্ব কমেনি বরং বুননবৈচিত্র্যে যুগ যুগ পেরিয়ে মানুষের কাছে এর আকর্ষণ নতুন করে ফিরে এসেছে। এখন তো খাদি হয়ে উঠেছে রঙিন, ডিজাইনের ভিন্নতায় অনন্য। ফলে তরুণদের মনও জয় করে নিয়েছে খাদি।

Read More
Clothing
Muslim Corner

বাঙালির ঐতিহ্য খাদি কাপড়ে পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাদামাটা নকশায় আগত আধুনিকতার ছোয়া ও বুননবৈচিত্র্যে নতুন করে দেশের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করছে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য খাদি কাপড়। দেশে-বিদেশে বাঙালি স্বকীয়তার আদলে গড়ে ওঠা ফ্যাশন হাউসগুলোকে কেন্দ্র করে ক্রমে তৈরি হচ্ছে খাদি কাপড়ের প্রতি নতুন প্রজন্মের আগ্রহের জায়গা।

Read More